অধ্যাপক ডা. শাকিল
অধ্যাপক ডা. এসএম খালিদ মাহমুদ শাকিল, একাধারে একজন প্রাজ্ঞ চিকিৎসক, জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত মানবতাবাদী এবং দক্ষ সংগঠক হিসেবে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার নৈকাঠি গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে তাঁর জন্ম। জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ এই পরিবারের রক্তে মিশে আছে। তাঁর পিতা, মরহুম হরমুজ আলী, ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সিনিয়র সহকারী সচিব। রত্নগর্ভা মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে ডা. শাকিল তৃতীয়। তাঁরা তিন ভাই উচ্চডিগ্রিপ্রাপ্ত চিকিৎসক, একজন শিক্ষক এবং তিন বোনও উচ্চশিক্ষিত। মেজো ভাই অধ্যাপক কামালউদ্দিন শাহিন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত।
ডা. শাকিলের ব্যতিক্রমী জীবনের শুরু থেকেই নেতৃত্বের দ্যুতি ছড়াতে শুরু করে। বরিশাল ক্যাডেট কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর, ১৯৯০ সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এই সময়েই তাঁর জীবনের গতিপথ নতুন মোড় নেয়। বিএনপির চেয়ারপার্সনের সম্মানিত উপদেষ্টা, তাঁরই সহোদর ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দারের সান্নিধ্যে এসে তিনি গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন এবং ছাত্ররাজনীতির সক্রিয় আঙিনায় প্রবেশ করেন।
১৯৯১ সালের উত্তাল সময়ে, যখন ক্যাম্পাস জুড়ে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য, তখন ডা. শাকিল বেশকিছু সতীর্থদের সাথে নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ বপন ও প্রসারে এক সাহসী অভিযাত্রা শুরু করেন। সেই শুরু, আর তাঁকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মেডিকেল কলেজে ছাত্রদলের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত হন। আল্লাহর অসীম কৃপা এবং তাঁর সুনিপুণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতির গুরুভার অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পালন করেন।
১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘনঘটা, যখন অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে, তখন ডা. শাকিল তাঁর নিজের জেলা ঝালকাঠিতে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক ইস্পাতকঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এর ফলস্বরূপ, তৎকালীন প্রশাসন কর্তৃক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলায় তিনি কারারুদ্ধ হন এবং দীর্ঘ ৬৫ দিন কারাভোগের পর অবশেষে জামিনে মুক্তি লাভ করেন। এখানেই শেষ নয়, বরিশাল আওয়ামী লীগ কর্তৃক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৯৯৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ এবং রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় রাজবন্দী হিসেবে তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। সেই কঠিন সময়ে ঝালকাঠির স্থানীয় আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির বিষ নজরে পড়েন ডা. শাকিল। এমনকি তাঁর পিতার স্মৃতিবিজড়িত বসতভিটাও নির্মমভাবে আগুনে ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়।
তবে কোনো প্রকার প্রতিকূলতা কিংবা বাধাই তাঁর আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাসকে এতটুকু টলাতে পারেনি। বরিশাল ও ঝালকাঠির আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে পটুয়াখালী ও বরগুনার রাজনীতিতেও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলেন। এর ফলস্বরূপ, ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রদ্রোহী ও অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের মিথ্যা অভিযোগে তিনি পুনরায় ৯৩ দিন কারা প্রকোষ্ঠে রাজবন্দি থাকেন। এসব ভিত্তিহীন মামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণবঙ্গে জাতীয়তাবাদী শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া।
২০০০ সালে এক শুভ ও স্মরণীয় মুহূর্তে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সনের উপস্থিতিতে বরিশাল-৩ আসনের মাননীয় সাংসদ মোশাররফ হোসেন মঙ্গুর একমাত্র কন্যা অধ্যাপক ডা. জাহানারা আক্তার লাইজুর সাথে তিনি পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
কর্মজীবনে পদার্পণ করার পর ডা. শাকিল জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের জন্য ক্লান্তিহীন সাধনা করে গেছেন। ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ২০১০ সালে পেডিয়াট্রিক সার্জারিতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হয়ে ২০১৬ সালে সাফল্যের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ২০১৭ সালে তিনি ক্লিনিক্যাল অ্যাডভান্স ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে এবং ২০১৯ সালে ইতালির রোমের বিখ্যাত হাসপাতাল থেকে নবজাতক সার্জারির উপর মূল্যবান ক্লিনিক্যাল ফেলোশিপ অর্জন করেন। চিকিৎসা সেবার আধুনিক জ্ঞান আহরণের জন্য তিনি বহুবার উচ্চতর ও প্রফেশনাল আপডেটিং ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। এখানেই তাঁর জ্ঞানপিপাসা থামেনি, ২০২৩ সালে রিজেনারেটিভ মেডিসিন (Umbilical cord tissue & cord blood derived mesenchymal stem cell) এর উপর অ্যাডভান্স ট্রেনিং গ্রহণ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তে এক নবীন মাইলফলক স্থাপন করেন।
জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার কারণে কর্মজীবনে পদে পদে তাঁকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। ২০১৭ সালে তিনি বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং ২০২৩ সালে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন, যদিও ২০১৯ সালেই তিনি এই পদোন্নতির ন্যায্য অধিকার অর্জন করেছিলেন। সর্বশেষ ২০২৪ সাল থেকে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের প্রফেসর হিসেবে অত্যন্ত সম্মান ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। হাসপাতালে জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ সার্জারি করার পাশাপাশি তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবেও সুপরিচিত। তাঁর হাসপাতালে ঘুষ, দুর্নীতি, অপরাজনীতি, রোগী বাণিজ্য ইত্যাদি যেকোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার থেকে একটি চিকিৎসা বান্ধব হাসপাতালের ধারণা বাস্তবায়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু চিকিৎসা জগতেই নয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাঁর অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। প্রফেশনাল মিউজিক পারফরম্যান্সেও তিনি শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালনা পর্ষদের আওয়ামীপন্থী সদস্যরা যখন তাঁদের অতীতের কার্যকলাপের ভয়ে দায়িত্ব পালনে দ্বিধাগ্রস্ত, তখন হাসপাতালের টালমাটাল ব্যবস্থাপনাকে স্থিতিশীল করতে ডা. শাকিল এক দক্ষ সংকটমোচনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উপপরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই সময়ে তিনি হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, সর্বস্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়ন ও এর পরিধি সম্প্রসারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তাঁর ঐকান্তিক ও বলিষ্ঠ উদ্যোগেই নির্মিত হয় অত্যাধুনিক মর্ডান অপারেশন থিয়েটার এবং বাংলাদেশে প্রথম পেডিয়াট্রিক সার্জিক্যাল আইসিইউ।
হাসপাতালের উন্নয়নে আত্মনিবেদিত হয়ে কাজ করতে গিয়েও তিনি আওয়ামী লীগের অনুসারীদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রেহাই পাননি, যা সকলেরই জানা। তবুও ব্যক্তিগত দৃঢ়তা ও হার না মানা মানসিকতার অদম্য শক্তির বলে তিনি তাঁর মহৎ পরিকল্পনা থেকে এক চুলও বিচ্যুত হননি। মানব সেবার মহান ব্রতকে ধারণ করে জাতীয়তাবাদী আদর্শের এই নির্ভীক যোদ্ধা মানুষের দুয়ারে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে বারবার ছুটে গিয়েছেন সেই দক্ষিণবঙ্গের ঝালকাঠিতে, যেখান থেকে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। এমনকি বরিশাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যাওয়ার পথে নিজ হাসপাতালের জরুরি দাপ্তরিক কাজে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েও তিনি থেমে যাননি। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তিনি প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
ইতোমধ্যে ঝালকাঠির প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারই উদ্যেগে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে বিশেষজ্ঞ টিমের মাধ্যমে ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করে অবহেলিত মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ডা. শাকিলের মতো ব্যতিক্রমী চিকিৎসক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে বিরল। যিনি শুধু অসাধারণ দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিতে জানেন না, বরং সকল প্রকার প্রতিকূলতাকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে একটি প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিতে হয়, সেই জ্ঞানও তাঁর অধিগত। ক্যাডেট কলেজের সুশৃঙ্খল জীবন, মেডিকেল কলেজের সফল ছাত্র নেতৃত্ব এবং বারবার আওয়ামী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েও নির্ভীক নেতৃত্বদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রি, ফেলোশিপ, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বাংলাদেশে প্রথম স্টেম সেল গবেষক হওয়ার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একাধারে একজন সংবেদনশীল হৃদয় ও একজন দক্ষ সংগঠক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যোগ্য ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের বড় অভাব। জাতীয়তাবাদী আদর্শে অবিচল বিশ্বাসী এবং সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম এমন ডাক্তারের আজ বড় প্রয়োজন। অধ্যাপক ডা. এসএম খালিদ মাহমুদ শাকিল তেমনই এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর কর্ম ও আদর্শের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই জনমনে এক বিশেষ ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
এসএম রেজাউল করিম
সাবেক ছাত্রনেতা ও সমাজকর্মী
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com