গ্যাস নিয়ে সংকট বাড়ছে
দেশে জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে দ্রুত গতিতে, বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা তৈরি হয়েছেÑ এমন অবস্থায়ও গতানুগতিক ধারায় কাজ করছে পেট্রোবাংলা। অনেকটা লোক দেখানো পরিকল্পনা আর দফায় দফায় বৈঠকই সার। ২০১৫ সালে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান ছিল প্রায় ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট; গত ৯ বছরে তা কমতে কমতে গড়ে দুই হাজার থেকে ২২শ’ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। এখন প্রায় ৯০০শ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে প্রতিদিন গড়ে ২৭শ’ থেকে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আমদানি করা এলএজির জন্য গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। দেশীয় উৎসে গ্যাসের অনুসন্ধানে ধীরগতি, সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধানে খামখেয়ালি এবং এলএনজি আমদানিতে বেশি উৎসাহের কারণে গ্যাসের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যাপক ফারাক তৈরি হয়েছে। ক্রমান্বয়ে স্থবির হয়ে পড়ছে শিল্প-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন। গতি কমছে অর্থনীতির চাকার।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে অন্তত ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে পেট্রোবাংলা বলছে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ছাড়া গ্যাসের উৎপাদন, সরবরাহ এবং রাজস্ব আদায়ের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক ফারাক। এখনও গ্যাস উৎপাদন, আমদানি এবং গ্রাহকের কাছে বিক্রির প্রক্রিয়াকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে পারেনি পেট্রোবাংলার অধীনস্থ কোম্পানিগুলো। সিস্টেম লসের নামে শিল্প-কারখানায় অব্যাহত গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটছে। সারা বছর বিতরণ কোম্পানিগুলো অভিযান চালাচ্ছে, তবু ক্রমবর্ধমান হারে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের অপব্যবহার হচ্ছে। আবাসিক খাতেও গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে।
জানা যায়, বিগত ১৫ বছরে নানা ধরনের পরিকল্পা করেছে পেট্রোবাংলা। যার মধ্যে অন্তত ১০০ নতুন কূপ খননের বিষয় রয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনার যৎসামান্য বাস্তবায়ন হয়েছে। ভোলা ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডে নতুন ও পুরনো কিছু কূপে গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ২০১২ সালের পর থেকে সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধানের জন্য দফায় দফায় বৈঠক, টেন্ডার আর পরিকল্পনা করাই চলছে। কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে জ্বালানি খাতে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার একাধিক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, গ্যাসের চাহিদা এবং পেট্রোবাংলার চলমান কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবেÑ ২০২৬ সাল নাগাদ গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয়ে পড়বে সংস্থাটি। পেট্রোবাংলা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে দেখা যায় আরও অন্তত ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সফলতা আসবে না। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে আমদানিনির্ভর এলএনজিই একমাত্র ভরসা। তবে দেশের আর্থিক সংকটে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে কিনা, সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।
এদিকে পেট্রোবাংলা কেন দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলো না বা গতানুগতিক কাজের মধ্যে বছরের পর বছর আটকে আছেÑ জানতে চাইলে সংস্থাটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সব জায়গায় সংস্কার হচ্ছে, পেট্রোবাংলায়ও সংস্কার প্রয়োজন। পেট্রোবাংলাকে গতিশীল করতে হলে সর্বপ্রথম সংস্থাটির আমলানির্ভরতা কমাতে হবে। এখানে পুরো কাজ হলো প্রকৌশলী ও বিশেষ জ্ঞানভিত্তিক মানব সম্পদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আমলানির্ভর হওয়ায় প্রকৌশলীদের চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। এখানে মূলত একজন অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সচিব হওয়ার আশায় থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা সংস্থার উন্নয়নে তাদের ভাবনা কম থাকে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের ভেতর থেকেই হওয়া উচিত। তাহলেই গতি ফিরবে।
দেশে এখন গ্যাসের গড় সরবরাহ ২৭ মিলিয়ন ঘনফুট। যার মধ্যে দুটি ভাসমান টার্মিনাল দিয়ে আমদানিকৃত ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়। সরকার পটুয়াখালীর পায়রায় আরও একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ সরকারের পরিকল্পনায় এলএনজি আমদানির কোনো বিকল্প তেমনভাবে নেই।
সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস আমদানি করায় গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৪.৩৮ টাকা। আর গ্যাসের গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ২২.৮৭ টাকা। এতে করে প্রতি ঘনমিটারে ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্পট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছিল ৬৫ টাকা, যা গত আগস্টে ৭১ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। গ্যাস আমদানি ও বিক্রির মধ্যে বেশি তফাত হওয়ার অন্যতম কারণ সিস্টেম লসের নামে চুরি। বছরের পর বছর চেষ্টা করেও পেট্রোবাংলা সিস্টেম লস বা চুরি ঠেকাতে পারেনি।
এদিকে যখন এক-তৃতীয়াংশ আমদানি করতেই সরকারের আর্থিক দৈন্যদশা প্রকাশ পাচ্ছে, সেখানে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ ফুরিয়ে আসছে, এতে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে এলএনজি আমদানি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, ভুল নীতি আর দুর্নীতির ওপর ভর করেই দেশের জ্বালানি খাত চলছে। ২০২৫-২০২৬ সালের দিকে যে গ্যাস খাতে সংকট প্রকট হতে পারে, সেটা অনেক আগেই বলা হয়েছে। তবু পেট্রোবাংলা কার্যত তেমন উদ্যোগ নেয়নি। আমলানির্ভর পেট্রোবাংলা গতানুগতিক ধারায়ই চলে আসছে। গ্যাস খাতে চুরিও বন্ধ করা যায়নি। যদিও কিছু কারিগরি লোকসান বা সিস্টেম লস থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো কোনো কোম্পানির সিস্টেম লস মাত্রাতিরিক্ত। যেখানে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সিস্টেম লস বিবেচ্য হতে পারে, সেখানে কোম্পানিগুলোর কোনো কোনো অঞ্চলে ৩০ শতাংশের বেশিও সিস্টেম লস রয়েছে। এসব বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর আমূল সংস্কার দরকার।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করলে এক সময় শেষ হবে। তবে আমাদের ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি কূপ খননের মাধ্যমে ৬০০ মিলিয়ন উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে ১৬টি কূপ খননের মাধ্যমে ১৯০ মিলিয়ন উৎপাদন বেড়েছে। এ ছাড়া আরও ১০০টি কূপ খননের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গভীর সমুদ্র ও পার্বত্য এলাকায় গ্যাস প্রাপ্তির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। সাগরে গ্যাস উত্তোলনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, সেখানে গ্যাসের সন্ধান পেলেও ৮ থেকে ১২ বছর সময় লাগবে। আর পার্বত্য এলাকায় দরপত্র আহ্বানের জন্য মডেল পিএসসি (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) প্রণয়নের কাজ চলছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক
বাংলার আলো মিডিয়া লিমিটেড
৮৯ বিজয় নগর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম শরণি, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট (৫ম তলা)। ঢাকা-১০০০
নিউজঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪১ || [email protected] || বিজ্ঞাপণঃ +৮৮ ০১৩৩২৫২৮২৪৩ || [email protected]
©২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || banglaralo24.com